শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া গড়ার ডাক

শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতা এবং নীতিনির্ধারকদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা যদি জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে

সম্মিলিতভাবে কাজ করি, তবে অবশ্যই দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবে। বুধবার বিকালে রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের

জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ১০ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য ও জমকালো অনুষ্ঠানমালার অষ্টম দিনের অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ

মানুষের বসবাস। এ অঞ্চলে যেমন সমস্যা রয়েছে, তেমনি আছে প্রচুর সম্ভাবনা। আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের অসম্ভব প্রাণশক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় জয় করে টিকে থাকার দক্ষতা আছে।

পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রাপ্ত সম্পদ কাজে লাগিয়ে আমরা সহজেই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটাতে পারি। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের

জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালার অষ্টম দিনের মূল থিম ছিল-‘শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’। অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন শেখ হাসিনা। সম্মানিত অতিথি

হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। দিনের মূল থিমের ওপর বক্তব্য দেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ

মাহমুদ আলী। এ ছাড়া সম্মানিত অতিথি হিসাবে ভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং পোপ ফ্রান্সিস ভিডিওবার্তা দেন। সভাপতির বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই

অনুষ্ঠানমালাকে ঘিরে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে মালদ্বীপ ও নেপালের রাষ্ট্রপতিদ্বয়, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন। আজ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে

শেরিং সম্মানিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত হয়েছেন। তার উপস্থিতি এ অনুষ্ঠানকে মহিমান্বিত করেছে। এতে আমরা সম্মানিতবোধ করছি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় ভুটানের রাজা ও সেদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা

জানান। ভুটান বাংলাদেশের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগোলিক নৈকট্য ছাড়াও দুদেশের রয়েছে প্রায় একই ধরনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক

বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের অবস্থান প্রায় এক ও অভিন্ন। আমরা সব সময় একে অপরকে সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাচ্ছি। দুদেশের জনগণের মধ্যে যে সম্পর্ক, এটা অনেক প্রাচীন।ভুটান সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি

দিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভুটানই প্রথম দেশ, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তখনও বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, এর আগেই ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ওই দিনটির কথা আমরা ভুলতে পারি না। তখন আমরা বন্দিশিবিরে ছিলাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেমন আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ

মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেছিল, তেমনি গ্রেফতার করে আমার মা, আমাকে, আমার ছোটবোন শেখ রেহানাকে। ছোট্ট রাসেল, পাঁচ মাস বয়সি জয়সহ আমরা সবাই বন্দি কারাগারে ছিলাম। সেদিন রেডিওতে আমরা প্রথম শুনতে

পেলাম ভুটান আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই দিনটি আমাদের জন্য অনন্য দিন ছিল। হাসি-কান্নার মধ্যদিয়ে সেদিনটি আমাদের কেটেছিল। কাজেই আমরা সব সময় ভুটানের কথা স্মরণ করি। মহান

মুক্তিযুদ্ধে যেসব বন্ধুরাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছেন, তাদেরকে আমরা সম্মাননা দিয়েছি। ২০১২ সালে ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকেও আমরা সম্মাননা দিয়েছি। দুদেশের মধ্যে

বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার হচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, যোগাযোগ, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য

সংখ্যক ভুটানি ছাত্র-ছাত্রী চিকিৎসাশাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। আমাদের সম্মানিত অতিথি ডা. লোটে শেরিং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। তাই

তিনি শুধু ভুটানের নন, তিনি বাংলাদেশেরও। আমরা তাকে এভাবেই দেখি। এজন্য আমরা অত্যন্ত গর্বিত। তার উপস্থিতি এই অনুষ্ঠানকে মহিমান্বিত করেছে এবং আমরা নিজেরা সম্মানিতবোধ করছি। আমি আমার নিজের, ছোটবোন

শেখ রেহানার এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে তাঁকে এবং ভুটানের জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এ ছাড়া ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, পোপ ফ্রান্সেস, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয়

এলিজাবেথ, চীনের প্রেসিডেন্টসহ যারা ভিডিওবার্তা পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তাদেরও আমরা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই করোনা মহামারি থেকে গোটা বিশ্বের মানুষ

মুক্তি পাক, সবাই সুস্থ ও ভালো থাকুন-এই কামনাই করি। বঙ্গবন্ধু সব সময় নিপীড়িত মানুষের পাশে ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য

লড়াই করেন। তিনি বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। তিনি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সব

সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়-সেই পররাষ্ট্রনীতিও তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর

ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। ২০৩১ সালের মধ্যে

উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে মুজিব চিরন্তন শ্রদ্ধা-স্মারক উপহার দেন জাতির পিতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। দুদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ডা. লোটে শেরিং

সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, একটি অনুপ্রেরণা। তিনি স্বদেশে-বিদেশে

অনুপ্রেরণার নিশানা। বঙ্গবন্ধুর নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যে পথে পরিচালিত করেছেন, তাতে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।